মাওলানা মুহাম্মাদ মাসউদ রিজভী :
মাহে রমাদ্বান শরীফের ১৭তম দিবস। ১৪৪৫ হিজরী। ঐতিহাসিক বদর দিবস। ১৭রমাদ্বান। ২য় হিজরী মোতাবেক ১৭মার্চ, ৬২৪ ঈসায়ি। জুমাবার। কাঠ ফাটা রোদ। তপ্ত মরুভূমি। উত্তপ্ত হাওয়া। পূণ্যভূমি মদীনা থেকে বেশ দূরের এক পাহাড়ি উপত্যকা। নাম বদর। মুখোমুখি দু’দল। লড়াই করতে এসেছে তারা। একদল এসেছে বাপ-দাদার ধর্মের মুখে চুনকালি লেপটে দেয়া আব্দুল্লাহর বেটা ও তাঁর দলকে এই পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে নিঃশেষ করে দিতে। অন্য দলটি এসেছে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসুল (দ.)’র আনুগত্যের প্রমান দিয়ে তাঁর মনোনিত দ্বীনের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে জীবন বিলিয়ে দিতে।
এক পক্ষে আছে, ঢাল তলোয়ারে সু-সজ্জিত প্রায় ১০০০ হাজার শক্তিশালী সশস্ত্র সৈন্য। ৩০০টি ঘোড়া এবং ৭০০টি উট। যাদের নেতৃত্বে আছে, মক্কার শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা আবু জাহল, উতবা ইবনে রাবিয়া, উমাইয়া ইবনে খালাফ প্রমুখ। অপর পক্ষে আছে, নিরিহ নিরস্ত্র ৩১৩ জনের এক দূর্বল বাহিনী। যাদের প্রায় সবাই পদাতিক। যুদ্ধ সামগ্রি বলতে মাত্র ২টি ঘোড়া আর ৭০টি উট। অস্ত্রও নেই তেমন। যৎসামান্য তলোয়ার আর কিছু তীর ধনুক। যাদের নেতৃত্বে আছেন স্বয়ং নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। চরম উৎকন্ঠা আর উত্তেজনাময় এক মূহুর্ত। এখুনি শুরু হবে যুদ্ধ। আরবিয় যুদ্ধ রীতি অনুযায়ি প্রথমে হবে দুপক্ষের শক্তি প্রদর্শন। এক পক্ষ থেকে এগিয়ে এলো যথাক্রমে কুরাইশদের সেরা বীর উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া এবং ওয়ালীদ ইবনে উতবা। অপর পক্ষ থেকে এলেন, সিংহ শিকারি আমির হামজা।
হযরত হামজা ইবনে আব্দুল মুত্তালিব। তারপর এলেন মাওলা আলী ইবনে আবি তালিব। যিনি নিজেই সিংহ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। আরো এলেন হযরত উবায়দা ইবনে হারিস। রাদিয়াল্লাহু আনহুম। প্রথম লড়াইয়ে নেমেই হযরত আমির হামজা, মাওলা আলী এবং উবায়দার কাছে উতবা ইবনে রাবিয়া, শাইবা ইবনে রাবিয়া এবং ওয়ালিদ ইবনে উতবা ধরাশায়ী হয়ে গেলো। একদিকে মনোবল ভেঙ্গে যাওয়ার হাহাকার আর অপর দিকে ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা বদর প্রান্তর। শুরু হয়ে যায় তুমুল যুদ্ধ। সশস্ত্র বাহিনীর সাথে নিরস্ত্র বাহিনীর লড়াই। সত্যের সাথে মিথ্যের লড়াই। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হায়দারী হুঙ্কারে ময়দানে ঝাপিয়ে পড়েছেন মহাবীর আলী। শত্রুর বুকে আছড়ে পড়ছে তাঁর দো-ধারা জুলফিকার। অপর দিকে সিংহ শিকারী বীর হামজাও ঝর তুলেছেন তাঁর তলোয়ার দিয়ে। পাল্লা দিয়ে উমরও তখন ময়দান কাঁপিয়ে যাচ্ছেন সমান তালে। একে একে বধ করে চলেছেন শত্রুদের। ঐতো দূরে দাড়িয়ে মহা-মহিম আবু বকর। পাশেই প্রাণাধিক প্রিয় হাবীব আলাইহিস সালাম।
সুক্ষ্ম নয়নে অবলোকন করে চলেছেন যুদ্ধের অবস্থা। রহমতের দুহাত তুলে দিলেন আকাশ পানে, ফরিয়াদের সূর তাঁর কন্ঠে ঝড়ে পড়ছে। “হে প্রভূ! আমাদের ধ্বংস করে দিওনা, তবে তোমার দ্বীন আর টিকে থাকবেনা।” এমন একটি ফরিয়াদের অপেক্ষাতেই যেন ছিলেন মহান আল্লাহ তাআলা, তাৎক্ষণিকভাবে নাজিল করলেন এক ‘চৌকস স্পেশাল ফোর্স’! যাদের যুদ্ধ করতে লাগেনা কোনো ঢাল তলোয়ার। মুহুর্তেই যেন খতম হয়ে যাচ্ছিল শত্রুপক্ষ। যারা কিছুক্ষণ আগেও তাদের শক্তির গিত গাইছিলো।
এখন তারাই দিক বিদিক ছুটে পালাচ্ছে। হ্যাঁ, আবু জাহেলও ইতোমধ্যে কুপোকাত হয়েছে দুজন অল্প বয়সি ‘নবীসেনা’র হাতে। তারা দু’ভাই। নাম, মা’আজ আর মুআওয়াজ। রাদিয়াল্লাহু আনহুমা। পরিকল্পনা অনুযায়িই ধরেছে তারা এই রাঘব বোয়ালটাকে। পালানোরও পথটাও হারিয়েছে সে। অগত্যা নতি স্বীকার করতেই হলো। কী লজ্জা! কী লজ্জা! শেষমেষ কিনা দুটো বাচ্চা ছেলের কাছে ‘বীর বাহাদুর’ কুপোকাত! কুরআনের ভাষায়, আর স্মরণ করো, আল্লাহ তোমাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, দুই দলের এক দল তোমাদের আয়ত্তে আসবে। অথচ তোমরা চাইছিলে যে নিরস্ত্র দলটি তোমাদের আয়ত্তে আসুক, আর আল্লাহ চাইছিলেন সত্যকে তাঁর বাণী দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং অবিশ্বাসীদেরকে নির্মূল করতে। কিসে যেনো ধাওয়া করেছে। দিকবিদিকে দিশেহারা হয়ে ছুটে পালাচ্ছে তারা। এখন আর যুদ্ধ নয় যেন নিজের জানটা হাতে নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারলেই হয়। কী লীলা তাঁর! আচমকাই যেন সব দৃশ্যপট পাল্টে গিয়েছে। প্রিয় হাবীব জমিনে লুটিয়ে পড়লেন, কপাল ঠেকিয়ে দিলেন স্বীয় রবের কুদরতি ক্বদমে। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে প্রবল বেগে অশ্রুধারা। না এটা কষ্টের অশ্রু নয় এটা আনন্দাশ্রু। এ যেন প্রিয় বন্ধুর প্রতি শুকরিয়া আদায় করার এক মহা আয়োজন। এক সময় শেষ হলো যুদ্ধ। চারিদিকে ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ। তবুও আজ আনন্দ লাগছে সবার। কারণ, ঐতো কালিমার পতাকা স্ব-গৌরবে জানান দিচ্ছে তাঁর অবস্থান। পতপত করে উড়ছে খোলা আকাশে। এবারে হিসেব মিলানোর পালা।
১৪জন বীর শহীদের বিপরীতে ৭০জন নিহত। এক শেরে খোদা মাওলা আলীর হাতেই ৪০জন শেষ! হবেইতো খোদার সিংহ বলে কথা। আরও ৭০জন বন্দি। পৃথিবী আজ নীরব স্বাক্ষী হয়েছে এক ঐতিহাসিক যুদ্ধের। যা পার্থক্য করে দিয়েছে সত্য আর মিথ্যাকে। হক আর বাতিলকে। যার কথা পৃথিবী নামক এই ভূখন্ড কখনোই ভূলে যাবেনা। জঙ্গে বদর : ঈমানদীপ্ত বিজয়ের এক সোনালি ইতিহাস। সকল বদরি সাহাবীগণের করমকলে জানাই হাজারো সালাম।